থাইরয়েড নরমাল কত? জেনে নিন স্বাভাবিক রেফারেন্স রেঞ্জ

Medically Reviewed By
Prof. Ashok Rattan
Written By Komal Daryani
on Apr 15, 2025
Last Edit Made By Komal Daryani
on Jul 19, 2025

আপনি কি জানেন যে সারা বিশ্বে প্রায় ২০ কোটিরও বেশি মানুষ থাইরয়েড রোগে আক্রান্ত? এই রোগটি আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি – থাইরয়েড গ্ল্যান্ড – এর সঙ্গে জড়িত, যাকে বলা যায় শরীরের মাস্টার কন্ট্রোল প্যানেল। চলুন, এই ব্লগের মাধ্যমে থাইরয়েড রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক – যেমন এর কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধের উপায় ইত্যাদি। এই তথ্যগুলো আপনাকে থাইরয়েড থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।
থাইরয়েড কী?
থাইরয়েড হলো গলার নিচে অবস্থিত একটি ছোট গ্রন্থি (gland)। এটি দেখতে প্রজাপতির মতো এবং এটি শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে। মেটাবলিজম মানে হলো – শরীর কতটা দ্রুত শক্তি উৎপাদন করছে বা ব্যয় করছে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে দুটি প্রধান হরমোন নিঃসৃত হয়:
এই হরমোনগুলির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে একটি হরমোন যার নাম TSH (Thyroid Stimulating Hormone)। এই TSH তৈরি হয় মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে।
থাইরয়েডের সমস্যা হলে কী কী লক্ষণ দেখা যায়?
হাইপোথাইরয়েডিজম-এর লক্ষণ
- অতিরিক্ত ক্লান্তি
- ওজন বৃদ্ধি
- ঠান্ডা বেশি লাগা
- ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
- চুল পড়া
- মন খারাপ থাকা
- মাসিক অনিয়ম
হাইপারথাইরয়েডিজম-এর লক্ষণ
- ওজন কমে যাওয়া
- অতিরিক্ত ঘাম
- বুক ধড়ফড় করা
- নার্ভাস ফিল করা
- ঘুম না হওয়া
- চোখ ফুলে যাওয়া
- মাসিক অনিয়ম
থাইরয়েডের নরমাল রেঞ্জ (Normal Thyroid Level)
রক্ত পরীক্ষা করে সাধারণত তিনটি হরমোন দেখা হয় – TSH, T3 এবং T4। নিচে প্রতিটির স্বাভাবিক মাত্রা দেওয়া হল (অনেক সময় ল্যাবভেদে সামান্য পার্থক্য হতে পারে):
| পরীক্ষা | নরমাল রেঞ্জ |
| TSH | 0.4 – 4.0 mIU/L |
| T3 | 100 – 200 ng/dL |
| T4 | 5.0 – 12.0 µg/dL |
গর্ভাবস্থায় TSH রেঞ্জ একটু ভিন্ন হয়-
প্রথম ট্রাইমেস্টার: 0.1 – 2.5 mIU/L
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার: 0.2 – 3.0 mIU/L
তৃতীয় ট্রাইমেস্টার: 0.3 – 3.0 mIU/L
থাইরয়েডের ধরণ
থাইরয়েড সমস্যার প্রধানত দুইটি ধরন আছে:
হাইপোথাইরয়েডিজম (Hypothyroidism)
এই ক্ষেত্রে শরীরে থাইরয়েড হরমোন কম তৈরি হয়। ফলে মেটাবলিজম ধীরে চলে, ওজন বাড়ে, ক্লান্তি লাগে ইত্যাদি।
হাইপারথাইরয়েডিজম (Hyperthyroidism)
এই অবস্থায় শরীর খুব বেশি থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে। ফলে ওজন কমে যায়, ঘাম বেশি হয়, বুক ধড়ফড় করে ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
হাইপোথাইরয়েডিজম এবং হাইপারথাইরয়েডিজমের ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা
এই দুই ধরনের থাইরয়েড সমস্যার নির্ণয়ের জন্য ডাক্তাররা সাধারণত রক্ত পরীক্ষার পরামর্শ দেন। এই টেস্টের মাধ্যমে শরীরে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা মাপা হয়। বিশেষ করে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন (TSH) এর পরিমাণ দেখা হয়।
হাইপোথাইরয়েডিজম এর ক্ষেত্রে TSH-এর মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি থাকে। কিছু ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের ছবি নেওয়ার জন্য ইমেজিং টেস্ট (যেমন আল্ট্রাসাউন্ড) করানোর কথা বলা হতে পারে। আবার কোনও কোনও সময় আয়োডিন আপটেক টেস্ট করানোরও প্রয়োজন হতে পারে।
এখন চলুন, দুই অবস্থার চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নিই –
হাইপারথাইরয়েডিজম
এই অবস্থায় চিকিৎসার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হয় –
শুরুতেই ডাক্তাররা বিটা ব্লকার নামক ওষুধ দিয়ে থাকেন, যা হৃদস্পন্দন কমাতে ও শরীরের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
তারপর হাইপারথাইরয়েডিজমের সঠিক কারণ বুঝে চিকিৎসা নির্ধারিত হয়। যেমন, গ্রেভস ডিজিজ থাকলে অ্যান্টি-থাইরয়েড ওষুধ দেওয়া হয়।
যদি ওষুধ কাজ না করে বা থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে কোনও গাঁঠ (নডিউল) থাকে, তবে রেডিওঅ্যাকটিভ আয়োডিন থেরাপি বা সার্জারির মাধ্যমে গ্ল্যান্ডটি অপসারণ করতে হতে পারে।
এই রোগের প্রধান চিকিৎসা হলো সিনথেটিক থাইরয়েড হরমোন (লেভোথাইরক্সিন) খাওয়া।
ডোজ নির্ধারণ করা হয় রোগীর বয়স, ওজন এবং রক্তে TSH-এর পরিমাণ অনুযায়ী।
চিকিৎসক নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করিয়ে সেই ডোজে পরিবর্তন আনেন, যাতে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ শরীরে সঠিক মাত্রায় থাকে।
এই দুই অবস্থার চিকিৎসা পুরোপুরি ডাক্তারি পরামর্শ অনুযায়ী হওয়া উচিত। চিকিৎসা চলাকালীন নিয়মিত ফলো-আপ, রক্ত পরীক্ষা ও লাইফস্টাইল মেনটেইন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কখন থাইরয়েড টেস্ট করানো দরকার?
নিচের লক্ষণগুলোর যেকোনো একটি থাকলে থাইরয়েড পরীক্ষা করানো উচিত:
- হঠাৎ ওজন পরিবর্তন
- চুল পড়া বেড়ে যাওয়া
- ক্লান্তি, ডিপ্রেশন বা মন খারাপ
- মাসিক সমস্যা
- গর্ভধারণে সমস্যা
- পরিবারে কারো থাইরয়েড সমস্যা থাকলে
থাইরয়েড সমস্যা থাকলে কী করা উচিত?
চিকিৎসকের পরামর্শ
থাইরয়েড সমস্যার চিকিৎসা সাধারণত হরমোনের মাধ্যমে হয়। যেমন – হাইপোথাইরয়েডিজম হলে “Thyroxine” ওষুধ দিতে হয়।
নিয়মিত টেস্ট করানো
ওষুধ শুরু হলে প্রতি ৩-৬ মাসে একবার TSH টেস্ট করাতে হয়, যাতে ডোজ ঠিকঠাক চলছে কিনা দেখা যায়।
থাইরয়েড রোগের জন্য উপকারী সুপারফুডস
থাইরয়েড রোগের চিকিৎসায় খাবারের ভূমিকা অনেক বড়। কিছু বিশেষ খাবার রয়েছে যেগুলিকে সুপারফুডস বলা হয় – নিচে এমন কিছু উপকারী খাবারের তালিকা দেওয়া হলো-
নারকেল- নারকেলে থাকে মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড (MCFA), যা শরীরের মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে।
ডিম- ডিমে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন ও সেলেনিয়াম থাকে, যা থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ব্রাজিল নাটস- এই নাটস গুলিতে থাকে প্রচুর সেলেনিয়াম, যা থাইরয়েড গ্ল্যান্ড সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। তবে একদিনে ১-২টির বেশি খাওয়া উচিত নয়, কারণ এতে সেলেনিয়ামের মাত্রা অনেক বেশি।
ডাল ও অন্যান্য ফলি জাতীয় খাবার- ডাল, ছোলা, রাজমা ইত্যাদিতে থাকে আয়রন, প্রোটিন ও ফাইবার, যা থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। ।
পালং শাক- পালং শাকে রয়েছে আয়োডিন ও আয়রন, যা থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বেরি ফল (যেমন ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, রাসবেরি)- এই ফলগুলোতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা থাইরয়েড গ্ল্যান্ডকে ফ্রি র্যাডিকাল থেকে রক্ষা করে। এতে গ্ল্যান্ডে ক্ষতি কম হয় এবং কার্যক্ষমতা ভালো থাকে।
থাইরয়েডের প্রভাব গর্ভাবস্থায়
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে থাইরয়েডের মাত্রা ঠিক রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ:
শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ থাইরয়েডের ওপর নির্ভর করে
হাইপোথাইরয়েডিজম থাকলে গর্ভপাত বা মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকি বাড়ে
চিকিৎসকের গাইডলাইন মেনে TSH লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার
ভুল ধারণা সম্পর্কে সচেতনতা
অনেকেই মনে করেন শুধুমাত্র ওজন বাড়লে বা চুল পড়লেই থাইরয়েড আছে। কিন্তু সবসময় সেটা না-ও হতে পারে। আবার অনেকে মনে করেন থাইরয়েড মানেই সারাজীবন ওষুধ খেতে হবে – এটাও সবসময় ঠিক না। সঠিক ডায়াগনোসিস, চিকিৎসা এবং লাইফস্টাইল ফলো করলে থাইরয়েড সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সচেতন থাকুন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন এবং সুস্থ থাকুন।

